editworkshop.blogspot.com |
অন্যান্য নাম : কলকে, পীত করবীরক, সুগন্ধি কুসুম, কলকি, হলদি কলকি, কড়ি, চায়না করবী
ইংরেজি নাম : Yellow oleander, Mexican oleander, Lucky Nut Tree
বৈজ্ঞানিক নাম : Thevetia peruviana
"ছলকে পড়ে কলকে ফুলের মধু যে আর রয় না
চাঁপার বনে গান ধরেছে ভিনদেশি কোন্ ময়না।"
কলকে ফুলের আদিবাস দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ও বলিভিয়ার উষ্ণ অঞ্চল। ষোল শতকে হিসপানি পাদ্রীগণ গীর্জার আশেপাশে লাগানোর জন্য এই গাছ আমাদের দেশে নিয়ে এসেছিলেন। এখনও প্রাচীন গীর্জার আশেপাশে কলকে গাছ দেখা যায়। এছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান জাতির মধ্যে প্রচলিত আছে, সকালে ঘুম থেকে উঠে কলকের ফুল-ফল দেখা শুভ লক্ষণ।
কলকে ফুল হলুদ, সাদা এবং কমলা- এই তিনটি রঙের হয়ে থাকে। ফুলে প্রচুর মধু থাকে, তাই সারাদিন গাছের আশেপাশে থাকে মৌমাছির আনাগোনা।
ফুল দেখতে হুঁকার কল্কের মতো, তাই সহজভাবেই বাংলায় এর এক নাম হয়েছে কল্কে। কেউ কেউ একে কল্কা ফুল বলে থাকেন যা হয়ত কল্কে নামেরই ঈষৎ রূপান্তর।
পারস্যে ব্যবহৃত ‘কল্কা’ নামটির আগমন ঘটেছে তুর্কী শব্দ কল্গা থেকে যার অর্থ পাতা। এই পাতাকে ‘মোটিফ’ হিসেবে বহুবার ব্যবহার করে তৈরি করা হয় শাড়ি, নকশিকাঁথা ও কাশ্মীরী শাল। প্রাচীনকালে এই বীজকে ছিদ্র করে মালা বানিয়ে গলায় ধারণ করতো পেরুর অধিবাসী।
এই গাছের বাকল, বীজ ও কষ বিষাক্ত। বিষক্রিয়ার ধরন হচ্ছে ফল মারাত্মক অবসাদক, পঙ্গুত্ব আরোপক ও ঘাতক।
গাছের আয়তন সীমিত, তাই বয়স্ক ব্যতিরেকে বৃক্ষ গণ্য নয়। কলকে পত্রবহুল, শাখা নমনীয় এবং শীর্ষ ছত্রাকৃতি। সারা বছর সবুজ পাতায় ঢাকা থাকে। কাণ্ড গোল, মসৃণ, হালকা ধুসর, নরম, অগুনতি শাখায় ছড়ানো ছিটানো। কলকে গাছ সাধারণত দশ পনেরো ফুট (৩ থেকে ৫ মিটারের মত) উঁচু হয়। কলকিগোত্রীয় অন্য গাছপালার মতো এদেরও সারাদেহ দুধকষপূর্ণ। পাতা, কান্ড, মূল, ফল, যেখানেই আঁচড় লাগুক, সেখান থেকেই আঠালো কষ বের হয়।
চিরহরিৎ এ গাছ অজস্র দীর্ঘরৈখিক পাতার ঘনবিন্যাসে এলায়িত, ছায়ানিবিড় ও সুশ্রী। কলকের পাতা চিকন ও সরু ছুরির মত শেষ প্রান্ত সুচালো, শাখায় সর্পিলভাবে ঘনবিন্যস্ত। বাংলায় চিরল বলে একটা কথা আছে। এই গাছের পাতাকে চিরল বলাই চলে। পাতা লম্বায় ১০ থেকে ১৫ সে. মি. পর্যন্ত, চওড়ায় ২ সে.মি.পর্যন্ত। রঙ ঘন সবুজ। বোঁটা ছোট।
কলকে ফুল হলুদ, সাদা এবং কমলা- এই তিনটি রঙের হয়ে থাকে। ফুলসংখ্যা সীমিত, পাতার সবুজে প্রস্টম্ফুটনের ঔজ্জ্বল্য প্রচ্ছন্ন থাকে। তবু ঘন-সবুজ পাতার পটভূমিতে হলুদ, সাদা কিংবা রক্তিম ফুলভরা কলকে অবশ্যই নান্দনিক। কলকে নামটি ফুলের কলকের মত আকৃতির জন্যই। কলকে ফুল লম্বায় ১০ সে. মি.। কলকে গাছের শাখার মাথায় ফুল ধরে। বৃতি গুলো একটার সাথে আর একটা লাগানো, সবুজ। লম্বায় ৩ সে.মি.। দল গুলো ৫ সে.মি. লম্বায়। প্রত্যেকটির সাথে প্রত্যেকটি যুক্ত। ফুলের পাপড়ি ৫ টি। পাপড়িগুলো প্যাঁচানো থাকে একটার সাথে একটা, নলাকৃতি, পরাগচক্র দলের গভীরে দৃশ্য। ফুল সুগন্ধি। ফুলের নিচের অংশ সরু, নলাকৃতি, প্রায় সবুজ এবং মৌগ্রন্থিধর। ফুলে প্রচুর মধু থাকে, তাই সারাদিন গাছের আশেপাশে থাকে মৌমাছির আনাগোনা। ফুল ফোটে প্রায় সারা বছর।
কলকে গাছে জোড়ায় জোড়ায় ফল ধরে। ফলের দুই প্রান্ত ঢালু তবে মধ্যখানে ফুলে ওঠা উঁচু থাকে, অর্থাৎ ডিম্বাকার। ফল শাঁসযুক্ত, কাঁচায় সবুজ বা ফ্যাকাসে হলদে, পাকলে ধূসর রঙের হয়ে থাকে। ফলের ভেতর বীজ থাকে। প্রতি ফলে ২ টি বীজ থাকে। বীজ পাকলে ফ্যাকাসে বাদামী হয়। ফল ও বীজ অত্যন্ত বিষাক্ত। ফল খেলে শীতজনিত ঘর্ম, উন্মত্ততা, প্রলাপ ও অন্যান্য স্নায়ুবিক লক্ষণ প্রকাশ পায়, বমি হয়, নাড়ীর স্পন্দন ধীর হতে হতে দৃষ্টি শক্তি স্থির হয়ে শেষে সংজ্ঞাহীনতা আসে এবং মৃত্যু পর্যন্ত হয়। বীজ খেলে মস্তিস্কে, পাকযন্ত্রে ও শিরদাঁড়ায় পক্ষাঘাত হয়ে মৃত্যু হয়। বীজের শাঁস-তীব্র বিষাক্ত, অত্যাধিক তিক্ত, চিবুলে জিভে অসাড়তা আসে, জিভ গরম হয়ে যায়। পরিপক্ব ফল ও গাছের শাখা কলম থেকে গাছ হয়। পরিপক্ব ফল মাটিতে রোপণ করলে এক-দুই মাসের মধ্যে চারা গজায়।
কলকে গাছ ভেষজ গুণসম্পন্ন। পাতা, ছাল ও বীজে থাকে কর্ডিয়াক টনিক ও কর্ডিয়াক স্টিমুলেন্ট।গুণসম্পন্ন। গাছের সাদা কষে আছে হৃদক্রিয়া বৃদ্ধিকারক গ্লাইকোসাইডস। বীজে আছে ফাইটোস্টেরল, গ্লাইকোসাইডস এবং নানান রকমের উত্তেজক রাসায়নিক পদার্থ। গাছের ত্বকের রস কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। কচি বীজ বেশ বিষাক্ত। গাছের ছাল অরিষ্ট কটু, তিক্ত, বিরেচক এবং বমনকারক। বিভিন্ন প্রকার সবিরাম জ্বরে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অল্প মাত্রায় ব্যবহার করলে হৃদয়ের শক্তি বৃদ্ধি হয়, অধিক মাত্রায় এটি ঘাতক। গাছের ত্বকের রস কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। গাছের ছাল ও মূলের ছাল প্রায় সমগুন সম্পন্ন। নবজ্বরে ও বিষমজ্বরে হিতকর। মূলের ছাল দিয়ে তৈরী তেল চর্মরোগ নাশক। ছালের মত পাতাও বিরেচক ও বমনকারক। মানুষ ও পশুর ক্ষেত্রে বিষাক্ত। পাতার ক্কাথ দিয়ে তৈরী তেল চুলকানিতে লাগালে উপকার হয়। চারাগাছ তিক্ত, তীক্ষ্ণ, অতিশয় কটু, উষ্ণ, সংকোচক, মুত্রকৃচ্ছ্রতায় উপকারী, চর্মরোগ নিবারক, শ্বেতী, ক্ষত, অর্শ, চক্ষুপীড়া, চুলকানি, জ্বর, ফুসফুসাবরন প্রদাহ এবং বাত-প্রশমক। ফল ও বীজ গর্ভস্রাবকারক, শোথ ও বাত রোগে বিরেচনার্থ ব্যবহার্য। বীজের ক্কাথ বমনকারক, শ্বসন-ক্রিয়া ব্যাহতকারী, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্তদ্ধকারক, অর্শনাশক। বীজের তৈল বমনকারক ও বিরেচক। হৃদয়ের বলকারক। গাছের দুগ্ধ রস বমনকারক, সবিরাম জ্বরনাশক। ক্ষতেও পা ফাটায় ব্যবহার্য। ফুলে হৃদয়ের বলকারক পদার্থ আছে। এর দ্বারা প্রস্তুত তেল চুলকানি নষ্ট করে। ফুলের মধু উপাদেয় খাদ্য।
No comments:
Post a Comment