অনন্য ভেষজ জিনসেং

এশিয়ান জিনসেং (Asian Ginseng)
https://dpeditworkshop.blogspot.com/
জিনসেং (ইংরেজি: Ginseng) Araliaceae পরিবারের Panax গণের একটি উদ্ভিদ প্রজাতি। এটি মাংসল মূলবিশিষ্ট এক ধরনের বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। এটি উত্তর গোলার্ধে পূর্ব এশিয়াতে, বিশেষ করে চীন, কোরিয়া ও পূর্ব সাইবেরিয়াতে, ঠান্ডা পরিবেশে জন্মে।

বিশ্ব জুড়েই জিনসেং এক অনন্য ভেষজ। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে মাঞ্চুরিয়ার (মাঞ্চুরিয়া (সরলীকৃত চীনা: 满洲; প্রথাগত চীনা: 滿洲; ফিনিন: Mǎnzhōu) উত্তরপূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত একটি বৃহৎ ভৌগোলিক অঞ্চলের ঐতিহাসিক নাম। ... (সরলীকৃত চীনা: 东北; প্রথাগত চীনা: 東北; ফিনিন: Dōngběi) নামে অভিহিত করা হয়) পাহাড়ি ঢালে ছিল এদের বিপুল আস্তানা। চীনে তখন এর শিকড় ছিল মানুষের খাদ্য। ক্রমে ক্রমে অসাধারণ গুণাবলী প্রকাশিত হলে এর আধুনিক উত্তরণ ঘটে ওষুধ হিসাবে। এর শিকড়ের আকৃতি প্রায়শ দেখা যায় মানব দেহের মতো, নিচের দিকে দুভাগ হয়ে যাওয়া পায়ের মত, আবার কখনো দেখা যায় হাত-পা উভয়ই। জিনসেং নামটিও এসেছে চীনা শব্দ ‘রেনশেন’ থেকে যার অর্থ মানুষের পা। প্রাচীন চীনারা ভেবেছে, প্রকৃতি এদের মনুষ্যরূপ দিয়েছে কারণ, এরা মানুষের জন্য খুব হিতকর। যে কারণেই হোক আজকের দিনেও পৃথিবীতে চীনই সবচেয়ে বেশি জিনসেং ব্যবহার করে যা তাদের সমাজে-সংস্কারে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। এই ভেষজের চাহিদা দিনদিন বেড়ে যাওয়ার ফলে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের পর কোরিয়া থেকে এর আমদানি শুরু হয়েছে, বিনিময়ে চীনাদের কাছ থেকে কোরিয়ানরা সংগ্রহ করেছে সিল্ক। ১৯০০ শতকে বনজ জিনসেং শেষ হওয়ার উপক্রম হলে আমেরিকা, কানাডা ও কোরিয়াতে শুরু হয়েছে চাষাবাদ, যা ছিল ভারতে এলাচি চাষের মতই একটি কঠিন কাজ।
২০০ বছর ধরে বিভিন্ন দেশ থেকে, বিশেষত আমেরিকা থেকে জিনসেং রফতানি হচ্ছে চীনে কিন্তু আমেরিকার মানুষ এর ভেষজ গুণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেনি। বুনো জিনসেং-এর প্রতি, বিশেষত মনুষ্য আকৃতিবিশিষ্ট শিকড়ের প্রতি চীনাদের বেশ দুর্বলতা ছিল, বেশি মূল্য দিয়ে হলেও সেগুলো তারা কিনে নিত। তাদের এমন আচরণ দেখে আমেরিকানদের বিশ্বাস হয়েছে, চীনাদের জিনসেং ব্যবহারের বিষয়টি মূলত কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। আর এই ভাবনা মাথায় রেখে তারা বংশপরম্পরায় বনবনানী থেকে উদ্ধার করে গেছে অমূল্য জিনসেং, কখনো এর ভেষজ গুণ খুঁজে বের করেনি। বুদ্ধিমান চীনারাও জিনসেং নিয়ে কখনো উচ্চবাচ্য করেনি, যেন আমেরিকানরা যাই ভাবে ভাবুক, তাদের জিনসেং পেলেই হল। মাত্র ১৯৬০ সালের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী এই ভেষজের অশেষ গুণাবলী প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
বিভিন্ন আকৃতির জিনসেং (Different type Ginseng)
চীন দেশবিদেশ থেকে এই শিকড় আমদানি করেছে কিন্তু নিজেরা চাষ করতে পারেনি। জিনসেং চাষের প্রধান শর্ত ছায়া। প্রকৃতিতে ওক, ম্যাপেল, বিচ ইত্যাদি গাছের ছায়ায় এদের জন্মাতে দেখা যায়। কিন্তু চীনদেশে একসময় ছায়ার অভাব দেখা দিয়েছে নিদারুণভাবে কারণ বড় গাছ কেটে তারা রান্নাবান্না ও ঘর উষ্ণ রাখার লাকড়ি তৈরি করেছে। ভূমির নিচে জিনসেং-এর রাইজোম বা কন্দ হয় না, চারা হয় বীজ থেকে। বীজ মাটিতে পড়লে তা সহজে অঙ্কুরোদগম হয় না কারণ প্রস্তুতিপর্বে তাপমাত্রা আর মৌসুমে অভ্যস্ত হতে এর সময় লাগে প্রায় দুবছর। এরপর একপাতা বের হতে ২-৩ বছর, দ্বিতীয় পাতা বের হতে আরো ২-৩ বছর। কখনো ৩-৪টি পাতা না বের হলে ফল ধরে না। অর্থাৎ প্রকৃতিতে ৭-৮ বছরের আগে পুষ্ট হয় না জিনসেং-এর শিকড়।
গ্রিনহাউসে শেড করে এখন যে চাষ করা হয় তাতে ৪ বছরেই ফসল তোলা যায়, শিকড়ও মোটাতাজা হয় কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে তেমন নয়, মূল্যও কম। তবে কম হলেও, এক পাউন্ডের মূল্য অন্তত হাজার ডলারের নিচে নয়, প্রাকৃতিক জিনসেং যার কয়েকগুণ বেশি। এখন অনেকে প্রকৃতিতে এর কৃত্রিম চাষ করার চেষ্টায় আছে, গাছের শেডের নিচে, যা গ্রিন হাউসে নেই। গ্রিনহাউসে চাষ করার একটি প্রধান অসুবিধা হল, যদি একবার ফসলে ‘ব্লাইট’ ছত্রাক দেখা দেয় তবে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা চাষের এলাকায় কারণ গাছগুলো খুব কাছাকাছি রোপন করা হয়। প্রকৃতিতে এই সমস্যা নেই, গাছগুলো থাকে দূরে দূরে। তবে ফসল তুলতে দেরি হয় কারণ গাছের প্রাকৃতিক জীবনচক্র, চাষের জীবনচক্রের প্রায় দ্বিগুণ। দীর্ঘকাল পরে হলেও এতে অর্থাগম হয় বেশি এবং রোগবালাইয়ের সম্ভাবনা থাকে সীমিত যা কখনো পুরো ফসল নষ্ট করে না।
আমেরিকান জিনসেং-এর চাষ শুরু হয়েছে প্রায় ৩০০ বছর আগে কানাডাতে। ক্যাথলিক মিশনারীরাই প্রথম লক্ষ্য করেছিল, উত্তর-পূর্ব চীনে মাঞ্চুরিয়ার মত প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও আবহাওয়া কানাডা ও আমেরিকাতেও রয়েছে। এই সূত্র ধরে মাসতিনেক খোঁজাখুজির পর মন্ট্রিয়ল, নিউইয়র্ক এবং ম্যাসাচুসিটস্‌-এ পাওয়া গেল এর সন্ধান যা একই গণ প্যানাক্সের অন্তর্গত প্যানাক্স কুইনকে.ফোলিয়াস (Panax quinquefolius), আর এশীয় জিনসেং হল প্যানাক্স জিনসেং (Panax ginseng)। আকার-আকৃতি ও ভেষজগুণে দুটো প্রজাতিই খুব কাছাকাছি।
জিনসেং চাষ শুরু করার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান নিউইয়র্কের জর্জ স্টানটনের। প্রথমদিকে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত কুশলী টিন-ক্রাফটের মানুষ; যা কেউ তৈরি করতে পারত না তিনি সেটা যেভাবেই হোক তৈরি করে ছাড়তেন। এই অধ্যবসায়ী মানুষটির স্বাস্থ্য ছিল রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মত দুর্বল, কিন্তু মানসিক শক্তি ও অধ্যবসায় ছিল আইনস্টাইনের মত। আইস্টাইন বলতেন, ‘আমি জিনিয়াস ধরনের লোক নই, অন্যের সঙ্গে আমার তফাৎ হল, আমি সমস্যার সঙ্গে দীর্ঘতর সময় লেগে থাকি।’ জর্জ স্ট্যান্টন রোগজীর্ণ শরীরে টিন-ক্র্যাফটের কাজ ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘ সময় লেগে রইলেন জিনসেং চাষে। এ সময়ে খুব কষ্ট করে তাকে বনাঞ্চলে অবস্থান করতে হত। এমতবস্থায় কাজের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল লক্ষ্যনীয়। হাতের তালুতে তিনি যখন জিনসেং-এর শিকড়কে রাখতেন তখন মনে হত, তিনি কোনো দোলনার শিশুকে সযত্নে ধারণ করছেন। অসাধারণ সাফল্যের পর ব্যর্থ চাষীরাই তাকে বলতে শুরু করেছিল, ‘ফাদার অব দি জিনসেং ইন্ডাস্ট্রি।’ এই অধ্যবসায়ী মানুষের মটো ছিল, ‘নিজে ক্ষয় হয়ে যাও তুমি, কিনতু মরিচা ধরিয়ো না।’
বাজারে যে সব জিনসেং ওষুধ বা টনিক হিসাবে পাওয়া যায় তাতে অনেক কিছুর মিশাল থাকে। বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য অন্তত ৫টি গাছকে এখন জিনসেং বলে অভিহিত করা হয় এবং নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা হয়।
আদি জিনসেং (Panax ginseng)
আমেরিকান জিনসেং (Panax quinquefolius)
ইন্ডিয়ান জিনসেং (Withania somnifera)
সাইবেরিয়ান জিনসেং (Eleutherococcus senticosus)
ব্রাজিলিয়ান জিনসেং (Pfaffia paniculata)
উল্লিখিত সব ক’টি জিনসেঙেরই সাধারণ গুণ ‘অ্যাডাপ্টোজেন’ হিসাবে কাজ করা, অর্থাৎ দৈহিক ও মানসিক চাপকে সহনশীলতার মধ্যে নিয়ে আসা। কুখাদ্য খাওয়া, দূষিত পরিবেশে বাস করা, আতঙ্কগ্রস্ত হওয়া, মানসিক চাপ বহন করা ইত্যাদি নানা কারণে মানুষের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যায় এবং অকালবার্ধক্য দেখা দেয়। অ্যাডাপ্টোজেন দেহমনকে এসব ক্ষতিকর অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয় বা ‘অ্যাডাপ্ট’ করে নেয়। এতে মানুষের জীবন সুখী, অর্থবহ হয়ে ওঠে এবং প্রকারান্তরে তার আয়ু বর্ধিত হয়; এক অবৈজ্ঞানিক হিসাবে যা ১২ বছরের মত। তবে কেবল বেঁচে থাকাটা চরম সার্থকতা নয়। শয্যাশায়ী হয়ে ঘরে শুয়ে থাকা আর হাওড়ে মাছ ধরতে যাওয়ার মধ্যে ‘কোয়ালিটি অব লাইফ’-এর বিস্তর তফাৎ রয়েছে।
সাধারণভাবে অ্যাডাপ্টোজেন হিসাবে কাজ করলেও একেকরকম জিনসেং একেকদিকে উন্নত। সাইবেরিয়ান জিনসেং, যুদ্ধরত সৈনিকদের অতিরিক্ত শক্তি যোগানোর জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে, এশীয় জিনসেং যৌবন অটুট রাখার জন্য, আমেরিকান জিনসেং দৈহিক জড়তা ও জীবকোষের স্বাস্থ্যের জন্য, ইন্ডিয়ান জিনসেং ইন্দ্রিয়শৈথিল্য ও বিপাকের জন্য উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশের ‘ইন্ডিয়ান জিনসেং’কে আমরা অশ্বগন্ধা বলে জানি। এর শিকড় থেকে অশ্বমূত্রের মত বোঁটকা গন্ধ নির্গত হওয়ার কারণে হয় এই নামকরণ। গন্ধের কারণে একে চিহ্নিতকরণে সুবিধা হলেও ওষুধ হিসাবে সেবন করতে যেন নাকে একটা গন্ধ-ভাপ এসে লাগে। যা হোক, এর গুণপনার কিন্তু কোনো শেষ নেই। আয়ুর্বেদ একে বলবীর্যের জন্য, ঠাণ্ডা-কাশি, শ্বেতী রোগ, পায়ের ফোলা, হার্টের অসুখ, ফোড়া ওঠা, শিশুদের কৃশতায়, গর্ভিনী দৌর্বল্য ইত্যাদি রোগে ব্যবহার করে।
শুধু পুরুষ নয়, নারীদের জন্যও জিনসেং নানা কাজ করে থাকে। বেদনাদায়ক পিএমএস, ব্রেস্ট ক্যান্সার রোধে এবং মেনোপজে এর ব্যবহার সঙ্গত।
মেনোপজের পর হাড়ের ঘণত্ব কমে যায় বলে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে সহজে ফ্রাকচার হতে পারে। এমতাবস্থায় জিনসেং সেবনে এই অবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়। অ্যান্টি-এজিং গুণাবলী থাকার কারণে জিনসেংকে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন প্রসাধনীতেও। মোটামুটি বিচারে আমেরিকান জিনসেং মহিলাদের জন্য এবং এশিয়ান জিনসেং পুরুষদের জন্য অধিক উপযোগী। অধিক মাত্রায় জিনসেং কখনো দীর্ঘদিন একটানা সেবন করা ঠিক নয় যার স্বাভাবিক মাত্রা দিনে এক বা দুইবার করে ২০০-৫০০ মিলিগ্রাম পাউডার, দুধ পানি ইত্যাদির সঙ্গে সেব্য।
বনেবাদাড়ে এত খোঁড়াখুড়ির পরও প্রকৃতিতে মাঝেমধ্যে এখনো কিছু জিনসেং পাওয়া যায়। চাষের জিনসেং থেকে একে সনাক্ত করার একটি উপায় হল, মাথার কাছে এর অতিরিক্ত কাণ্ডের উপস্থিতি, যে কাণ্ডের চারদিকে পত্রবৃন্তের ক্ষত থেকে অনুমান করা যায় গাছটির বয়স। এই কাণ্ড ভূমির উপরে থাকে, কিন্তু কখনো কখনো কাণ্ডহীন হয়ে মাটির নিচে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যায় যা খুঁজে বের করার সাধ্য কারো থাকে না। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, এটা হয়তো গাছের বংশরক্ষার এক অভিনব কৌশল। এতে আশাবাদ এই যে, অতি পুরাতন জাতের জিনসেং অত সহজে পৃথিবী থেকে লুপ্ত হবে না।
অনুপম ভেষজ অশ্বগন্ধা থাকতে আমাদের বিদেশী জিনসেং না হলেও চলে, যদিও বিদেশি ভেষজের ভিন্ন ধরনের উপকারিতা আছে। উপমহাদেশের যে সব পাহাড়িঢালের এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৫-৫০ ইঞ্চির মত সেখানে পত্রমোচী গাছের নিচে এদের প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কঠিন নয়। এ ছাড়া একে যত্নে রেখে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেও জন্মানো সম্ভব। তবে এক দেশের গাছ আরেক দেশে জন্মালে কিছু অঙ্গসংস্থানিক (Morphological) পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এতে শিকড় চিকন, মোটা, লম্বা কিংবা রসালো, নানারকম হতে পারে। এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হল, শিকড়ে কী কী উপাদান আছে আমাদের কল্যাণের জন্য, সেটুকু জানা। (সুত্রঃ ফেসবুক)

এশিয়ান জিনসেং (Asian Ginseng ) https://dpeditworkshop.blogspot.com/ জিনসেং  (ইংরেজি:  Ginseng ) Araliaceae পরিবারের Panax গণের একটি উ...